- 09 December, 2025
- 0 Comment(s)
- 282 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের মধ্যে। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আজীবন। ১৮৮০ সালে বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক রক্ষণশীল অভিজাত জমিদার বাড়িতে রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। রোকেয়ার প্রয়াণ মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, কলকাতায়। তাঁর জন্মও ৯ ডিসেম্বর বলে মনে করা হয়।
‘ক্ষমতায়ন কার্যকরী করার জন্য তিনটি পর্যায়কে বিবেচনা করা হয়। যেমন ব্যক্তিগত। এই পর্যায়ে বিবেচিত হয় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্যের ধারণা। অপরটি সম্পর্ক। এই পর্যায়ে দেখা যায় ব্যক্তির সম্পর্কযুক্ত ক্ষমতার সামর্থ্য। অর্থাৎ ব্যক্তি কতটা মধ্যস্থকারী ও অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারে কতটা সমর্থ। তৃতীয় সামষ্টিক। এই পর্যায়ে বিবেচিত হয় একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা।’ (সেলিনা হোসেন : ‘বাঙালির জাগরণে রোকেয়ার আত্মশক্তি’, রোকেয়া মানস ও সাহিত্য মূল্যায়ন — সম্পাদনা মহম্মদ শাকেরউল্লাহ, দে‘জ পাবিলিশিং, ২০১৭, পৃ. ১৩)। নারীর ক্ষমতায়ন বা উন্নয়ন বলতে নারী- পুরুষের মিলিত উন্নয়নের কথাই রোকেয়া বুঝিয়েছেন। কোন একটি শ্রেণি পিছিয়ে থাকলে সেই জনগোষ্ঠী, সেই সমাজ, সেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। রোকেয়া তাই পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে বলেছিলেন জেগে উঠতে। নারীদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নিয়ন্ত্রিত না হয়ে নিজেকেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। সমষ্টিগতভাবে কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন।
সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের ধারণা পাল্টাতে শুরু করে নারী শিক্ষার প্রসারের ফলে। যদিও একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোর মধ্যে নারীর ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ এল। প্রথমে তাঁদের শিক্ষাদানের মূল লক্ষ্য ছিল গৃহ সামলানোয় নিপুণ করে তোলা। আর স্বামীর যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে ওঠা। তবে উনিশ শতকের শেষের দিকে বাঙালি নারীদের আত্মপ্রকাশের স্বতন্ত্র একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেই পরিবেশের ধারায় রোকেয়া তুলেছিলেন পূর্ণ মনুষ্যত্বের অধিকারের প্রশ্ন। যোগ্য সহধর্মিণী হওয়াকে নারীদের বৃহত্তম লক্ষ্য বলে মনে করেননি। অবরোধের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করে প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে দেশের সুনাগরিক হওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর না হলে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তাই সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এই বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করার তাগিদে আপন লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। প্রতি মুহূর্তে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গঠন কৌশলের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছেন তাঁর বলিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে। নারীদের সামাজিক ভূমিকা কী হবে তা রূপায়ন করেছে পুরুষ। রোকেয়া তার বিরুদ্ধাচারণ করে ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে বলেছেন, নারীকে প্রতারণা করার জন্যই পুরুষরা ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলে প্রচার করেছে। আসলে এগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা। ‘একবার সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতাটি সংস্কৃত ভাষায় সনাতন ধর্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ রচনা করিলেন। তাই হিন্দু রমণীকে শিক্ষা দিলেন,-
“স্বামী বনিতার পতি, বনিতার গতি,
স্বামী বনিতার যে বিধাতা।
স্বামী বনিতার ধন, স্বামী বিনে অন্যজন,
কভু নহে সুখ মোক্ষদাতা।।”
আর হতভাগী মূর্খ নারী তাই মানিয়া লইল।’ (রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, কলকাতা, পৃ. ৬২৬)।
রোকেয়া মনে করেছিলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করছে। ধর্মই নারীর দাসত্বের বন্ধন দৃঢ করেছে। স্বামী শব্দের মধ্যেও অধিপতির দাপট রয়েছে। তাই বিবাহিত পুরুষকে কারো স্বামী শব্দের সম্ভাষণের ঘোর বিরোধী ছিলেন রোকেয়া। স্বামী মানে ঈশ্বর, অধিপতি, প্রভু বা মালিক। আমরা যখন বলি ভূস্বামী অর্থাৎ ভূমির (জমির) প্রভু বা মালিক। গৃহস্বামী মানে গৃহের প্রভু, ঈশ্বর বা মালিক। আর বিবাহিত স্বামী মানে কোন স্ত্রীর ঈশ্বর, প্রভু বা মালিক। সীতাকে আদর্শ নারী বলে সমাজ কেন দেখায়, এই প্রশ্নের সূচনা করেই তার উত্তরও দিয়েছেন রোকেয়া ‘অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে। সীতা রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গী, রানি, প্রণয়িনী, অন্যদিকে রামচন্দ্রও প্রেমিক এবং ধার্মিক। কিন্তু সীতার প্রতি রামের ব্যবহার দেখে মনে হয় বালকের সঙ্গে একটা পুতুলের সম্বন্ধ। বালক ইচ্ছে করলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসতে পারে। পুতুল হারিয়ে গেলে বিরহে অধীর হতে পারে। পুতুল ফিরে পেয়ে আনন্দে আটখানা হতে পারে। আবার বিনা কারণে রাগ করে পুতুলটাকে কাদায় ফেলে দিতে পারে। বালক পুতুলকে নিয়ে মনের মত খেলতে পারে। কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করতে পারে না। তার হাত, পা থাকলেও সে অচেতন পদার্থ। — ‘রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই, কেন না, বুঝিয়া কার্য্য করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটান যাইত না।’ (‘অর্ধাঙ্গী’, রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, কলকাতা, পৃ. ৩০-৩১)। রোকেয়া মনে করিয়ে দিয়েছেন, মেয়েরা পুতুল জীবন বহন করার জন্য আসেনি। তাঁদের হাত আছে, পা আছে, মস্তিষ্ক আছে। হাত, পা সবল, শক্তিশালী করতে হবে এবং জ্ঞানচর্চা করে দেশের উন্নয়নের কাজে যুক্ত হতে হবে। একটা শ্রেণিকে দুর্বল করে রাখলে সমাজ তথা দেশের ক্ষতি। এই প্রসঙ্গে রোকেয়ার বক্তব্য, একচোখে ভালো কাজ করা যায় না। গাড়ির একটি চাকা ভালো করে গড়াতে না পারলে সেই গাড়ির গতি কম হয়ে যায়। সেইরকম কোন সম্প্রদায় বা সমাজ তাদের মেয়েদের কর্মশক্তি ও মেধা চর্চার সুযোগ না দিলে শুধু সেই ব্যক্তির বা পরিবারের ক্ষতি নয়। সেই সম্প্রদায় এবং দেশের ক্ষতি। ‘মুক্তিফল’ ও ‘জ্ঞানফল' গল্পে নারীমুক্তির সঙ্গে স্বদেশের মুক্তিকে সম্পৃক্ত করে দেখেছেন তিনি।
রোকেয়ার রূপকথাধর্মী রচনা ‘মুক্তিফল' ও ‘জ্ঞানফল’। ইংরেজ শাসিত স্বদেশ, তাদের অত্যাচার এবং দেশের নানা চরিত্রের মানুষের পরিচয় রূপকথার আদলে ‘মুক্তিফল' গল্পে এঁকেছেন। ভোলাপুরের দুঃখিনী মা ও তার সন্তানরা আর মায়াপুরের দৈত্যদের নিয়ে গল্প রচিত হয়েছে। যিনি একসময় ভোলাপুর দেশের রানি ছিলেন তাঁকে হতে হয়েছে দুঃখিনী, কাঙালিনী। অসুস্থ কাঙালিনী খাবার, পোশাক ও ওষুধের অভাবে মৃতপ্রায়। মায়াপুর দেশের কৈলাস পর্বত থেকে মুক্তিফল আনলে সে সুস্থ হবে। এখানে বিদেশী ইংরেজ শাসক ও ভারত মাতার ছবি প্রতিকায়িত হয়েছে। ইংরেজদের কাছ থেকে মুক্তি পেলে তবেই কাঙালিনী অর্থাৎ ভারতমাতার মুমূর্ষু দশা কাটবে। কাঙালিনীকে এক সন্ন্যাসী জানিয়েছেন, কাঙালিনী মেয়েদের অবহেলা করেছে, আজ সেই মেয়েরা না গেলে মুক্তিফল পাওয়া যাবে না। কাঙালিনী ভালবাসত শুধু ছেলেদের। তার মনে হয়েছিল ভোলাপুর রাজ্য মেয়েরা রক্ষা করতে পারবে না, তাই তাদের যত্ন করে লাভ নেই। এই বৈষম্যের কারণে কাঙালিনীকে ভুগতে হচ্ছে। নারীর শ্রমশক্তিকে কেবল রান্নাঘরেই আটকে রাখার পক্ষে ছিলেন না রোকেয়া। ‘অর্দ্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নবস্ত্র; সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্য শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়।’ (রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, পৃ.৩৫) কাঙালিনীর মেয়েরা বাইরের কাজে অংশ নিতে চেয়েছে। কিন্তু কাঙালিনীর ছেলেরা এর বিরোধিতা করেছে। এখানে রোকেয়া কাঙালিনীর মেয়েদের মুখ দিয়ে শুনিয়েছেন, ‘আমাদিগকে মস্তক উত্তোলন করিতে না দিলে তোমাদেরও বলবৃদ্ধি হইবে না যে!’ নারী- পুরুষের সামগ্রিক শক্তিই দেশকে স্বাধীন করতে পারবে সেই দৃঢ বিশ্বাস রোকেয়ার ছিল। দেশের উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষ সকলের শ্রমশক্তির অন্তর্ভূক্তি দরকার। তাই রূপকথাকে বেছে নিয়েছেন তাঁর ইচ্ছে পূরণের জন্য। তাঁর রূপকথার নারীরা শেষপর্যন্ত আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। তারাও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। গল্পের শেষে দেখা যায় কাঙালিনীর মেয়ে শ্রীমতী, সুমতি, তাদের ভাই প্রবীণ, নবীন প্রমুখদের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হয়েছে মুক্তিফল এনে কাঙালিনী মাকে সুস্থ করার জন্য।
‘জ্ঞানফল' গল্পে পরীস্থান আর কনকদ্বীপের লড়াইয়ের কাহিনিতে জায়গা করে নিয়েছে দেশের ইতিহাস। পরীস্থানে শুধু মাকাল ফল আছে। মাকাল ফলের বদলে সমৃদ্ধশালী কনকদ্বীপের আম, ধান নিয়ে যায় পরীস্থানের জিন বণিকরা। কনকদ্বীপকে ঠকিয়ে তারা বাণিজ্যের বিস্তার ঘটায়। একবার মাকাল ফলের ভেতর ভুল করে পেয়ারা চলে আসে কনকদ্বীপে। সেই পেয়ারার বীজ থেকে পেয়ারা গাছ হয়। কনকদ্বীপের মানুষ পরীস্থানের মাকাল ফলের সঙ্গে আর কিছু বিনিময় করতে চায় না। পরীস্থানের বনিকরা পেয়ারা গাছের সন্ধান পেয়ে সেই গাছ কেটে ফেলে। মানুষের অনুনয়-বিনয়ে, পা ধরে কান্নাকাটিতেও তাদের নিরস্ত করা যায়নি। ‘পরীস্থানের জিন বণিকদের বাণিজ্য প্রকৌশলের আড়ালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের হিংস্র মুখ আর কনকদ্বীপের কান্তিপুষ্টিময় নিশ্চিন্ত মানুষগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষের নিশ্চেষ্ট চেহারাটা, বণিকের মানদণ্ডের আড়ালে লুকোনো রাজদণ্ডের আস্ফালনটুকু সহজেই চিনে নেওয়া যায় রোকেয়ের এই রূপকথায়; বুঝে নেওয়া যায় ব্রিটিশ অর্থনীতির ক্রমিক শোষণে ভারতের নিঃস্ব হয়ে আসার ছবিটিও। খুব প্রচ্ছন্ন থাকে না ব্রিটিশ সমৃদ্ধি আর ভারতের দারিদ্র্যের পালাবদলের ছবিটিও। কনকদ্বীপের ইতিহাসের মোড় ফেরার সময়টি, সেই অনতিঅতীত স্বদেশীযুগের বিদেশী- -পণ্য-বয়কট আন্দোলনের ছবিটাও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে কনকদ্বীপবাসীর মাকাল-বর্জনের প্রতিজ্ঞায়।’ (সুদক্ষিণা ঘোষ : ‘রূপকথা, রূপকথা নয় : রোকেয়ার কলমে’, মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত— রোকেয়া মানস ও সাহিত্য মূল্যায়ন, কমলিনী প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৬৭) পেয়ারা গাছ নিয়ে জিন, পরী ও তাদের বণিকদের সঙ্গে যখন লড়াই চলছে সেই সময় এক পণ্ডিত বলেন, এই পেয়ারা গাছের জন্য বৃথা কলহ না করে, তোমরা আদিম নারী হাবার রোপণ করা আদি বৃক্ষের সন্ধান করো। বহু নদনদী, প্রান্তর, জনপদ অতিক্রম করে সেই বৃক্ষের সন্ধান পেল কনকদ্বীপবাসীরা। কিন্তু সেই বৃক্ষ একেবারে শুকিয়ে তরু গিয়েছে। সেই শুকনো তরুকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হল তারা। এই বিফলতার কারণ হিসেবে এক সন্ন্যাসী বললেন, নারীর প্রতি বঞ্চনার প্রতিদান হল জ্ঞানবৃক্ষ শুকিয়ে যাওয়া। ‘দুই শত বৎসর হইল এই দেশের অদূরদর্শী স্বার্থপর পণ্ডিত মূর্খেরা ললনাদিগকে জ্ঞানফল ভক্ষণ করিতে নিষেধ করে; কালক্রমে ঐ নিষেধ সামাজিক বিধানরূপে পরিগণিত হইল এবং পুরুষেরা এ ফল নিজেদের জন্য একচেটিয়া করিয়া লইল।’ (জ্ঞানফল, রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, পৃ. ১৮০) কনকদ্বীপবাসীরা বুঝতে পারলো নারীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করেনি বলেই তারা শক্তির দিক থেকে দুর্বল। শিক্ষার দিক থেকে অপূর্ণ। সন্ন্যাসী বলেছেন, এখন তোমরা নারী পুরুষ মিলে জ্ঞানবৃক্ষের চাষ করো। নারী পুরুষের মিলিত জ্ঞানচর্চা ও সম্মিলিত শক্তিতে কনকদ্বীপ সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী হয়ে উঠল। পরীস্থানের জিন, দৈত্যরা কনকদ্বীপবাসীদের শোষণ করতে আর সাহস পেল না। রূপকথার আখ্যানে রোকেয়ার বৃহত্তর ভাবনা কাজ করেছে নারী মুক্তির সঙ্গে পরাধীন ভারতের মুক্তিকে মেলানোর মধ্যে। রোকেয়ার কাছে শিক্ষা মানে ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করা নয়। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে চেতনা গড়ে তোলা এবং সমাজ ও দেশের কাজে যুক্ত হওয়া। পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষার ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আজকের ভারতবর্ষে বসে ১৯০২ সালে লেখা রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ' (প্রকাশ ১৯২৪ সালে) পড়লে বিস্মিত হতে হয়। ধর্মীয় বিদ্বেষ, ভাষা বিদ্বেষের রাজনীতিতে এদেশের মানুষ এখন দিশেহারা। গেরুয়া রাজনীতির প্রধান এজেন্ডা দেশে ঘৃণার চাষ করা। রাজ্য তথা দেশে ধর্ষণ সংস্কৃতি বেড়ে চলেছে। ধর্ষণ রোখার জন্য দোষীকে কঠোর শাস্তি বা আইনি তৎপরতার বদলে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফতোয়া জারি করেছেন মেয়েদের রাতে বাইরে না বেরোতে। আজকের নারীবাদীরা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসাম্যের জন্য লড়াই করছেন। বহু অফিস, হাসপাতাল, থানা, রেল, প্রভৃতি জায়গায় দিন-রাত কাজ চলে। মেয়েরা রাতে না বেরোলে কাজের জগত থেকে পিছন দিকে সরতে হবে। শুধু দিনের কাজের প্রতিযোগিতায় মেয়েদের কাজে অংশগ্রহণের সংখ্যা কমবে। আর ধর্ষণ বাড়লে মেয়েদের কাজ দিতেও অনিচ্ছা তৈরি হবে অফিস কর্তাদের। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় বা ভাষিক বিভাজন দেখলে এবং নারীকে রক্ষা করার নামে শিক্ষা বা কর্ম জগত থেকে গৃহপরিসরে ঠেলে দেওয়ার ভাবনা ভাবলেই রোকেয়াকে স্মরণ করতে হয়। নারীশিক্ষা, নারীর স্বনির্ভরতা, সমাজের উন্নতির জন্য নারীর নেতৃত্ব গ্রহণ করার কথা সেই একশ তেইশ বছর আগে রোকেয়া লিখেছেন ‘পদ্মরাগ' উপন্যাসে। ‘পদ্মরাগ' তাই চিন্তার ভিন্ন দরজা খুলে দিয়ে নতুন আবিষ্কারের দাবি রাখে। এই উপন্যাসে রয়েছে তারিণী ভবনের জগত। পিতৃতন্ত্রের শেকল কেটে বেরিয়ে আসা মেয়েদের জন্য তৈরি এক আশ্রম। এখানে প্রত্যেকটি মেয়ে আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর। শ্রম দিয়ে প্রতিটি মেয়ে জীবিকা উপার্জন করে। তারিণী ভবন পরিচালনার দায়িত্ব তাদের। শুধু আশ্রমেই নয় বাইরেও তাদের পদচারণা। পথে কোন অসুস্থ, জখম অচেনা পুরুষ রুগীকে পড়ে থাকতে দেখলেও, তাকে নির্দ্বিধায় নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলার দৃঢ মনোবল রয়েছে তারিণী ভবনের মেয়েদের। পুরুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে এই মেয়েরা। এই আশ্রমে রয়েছে ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের মানুষ। তেমনই ভুটিয়া, নেপালি, মাদ্রাজি, কোল, সাঁওতাল, বিহারি, নানা শ্রেণির, নানা ভাষার মানুষ। এই তো প্রকৃত ভারতবর্ষ। যে ভারতকে গড়েছেন রোকেয়ার দীনতারিণী। যেখানে সব ধর্ম, সব ভাষা, সব শ্রেণি মিলেমিশে আত্মীয়তার অটুট সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। মানব-প্রেম ভাবনা, অসাম্প্রদায়িক মুক্ত মানসিকতা রোকেয়ার কাজে যেমন ধরা পড়ে তেমন সাহিত্যেও। ধর্মীয় বিদ্বেষহীন, লিঙ্গ বিভাজনহীন মানুষের মিলিত সহবস্থানে দেখতে চেয়েছিলেন নিজের দেশকে। আজকের ভারতবাসীও রোকেয়ার কাঙ্ক্ষিত সেই সহবস্থানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেশ গড়ার কাজে ‘পদ্মরাগ' উপন্যাস এখনও ভারতবাসীকে প্রেরণা যোগাবে।
‘Sultan’s Dream’ (১৯০৫ সালে মাদ্রাজের ‘Indian Ladies Magazine’- প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয় গ্রন্থকারে।) যেটা পরে বাংলা ভাষায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রোকেয়া প্রকাশ করেন, সেখানে স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে মেয়েদের অবস্থান কী হতে পারে তার ছবি এঁকেছেন। সমাজের তৈরি বয়ান হল, পুরুষের শক্তি বেশি বলেই তারা মেয়েদের ওপর প্রভুত্ব করতে পারে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’- এ সারার মুখ দিয়ে রোকেয়া বলেছেন, সিংহের শক্তি মানুষের চেয়ে বেশি বলে সিংহ কী মানুষের ওপর প্রভুত্ব করে? মানুষের বুদ্ধি, কৌশলে সিংহকে বন্দি করে রাখা হয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেয়েদের নিপীড়ন করে। রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ একটা কাল্পনিক নারীস্থান গঠন করে সেখানে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভয়ংকর প্রতিশোধ নিয়েছেন। শারীরিক বল বেশি থাকলে সে নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার পাবে এই অযৌক্তিক সামাজিক নির্মাণের বিরুদ্ধে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ -এর কাহিনি। রোকেয়ার দর্শনকে আরও স্পষ্ট করা যেতে পারে চিমামান্দা এনগোজি অদিচির বক্তব্য দিয়ে। ‘রোকেয়ার জন্মের ৯৭ বছর পর জন্মেছেন চিমামান্দা এনগোজি অদিচি (জন্ম ১৯৭৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নাইজেরিয়ার এনুগু শহরে)। তাঁর “We should all be feminist” (আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত, অনুবাদ : শিমিন মুশশারাত, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২১) গ্রন্থে যেন রোকেয়ার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনিও রোকেয়ার মতো দৈহিক শক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেছেন, নারীপুরুষ আলাদা। জৈবিক ক্ষমতাও আলাদা। এই তফাতের কারণ শুধু হরমোন আলাদা বলে। পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরন বেশি থাকায় তারা নারীদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তবে রোকেয়ার মতো তিনিও মনে করেননি বেশি শক্তি থাকলেই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। চিমামান্দা লিখেছেন— যে বেশি বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, সৃষ্টিশীল ও যার উদ্ভাবনী শক্তি প্রখর তিনিই নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী। আর এসব গুনের জন্য বিশেষ কোনো হরমোন নেই। নারীপুরুষ সকলেই বুদ্ধিমান। সকলেই সৃষ্টিশীল, সকলেই উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন। রোকেয়া, চিমামান্দা বা নারীবাদীরা চেয়েছেন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারীদের জ্ঞান, কর্ম, বিকাশের জন্য অনুকূল সামাজিক পরিবেশ।’ (আফরোজা খাতুন— 'রোকেয়া : নারী জাগরণের আত্মশক্তি’ চরাচর প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ৩০-৩১) রোকেয়ার নারীস্থানে মেয়েদের গড়ে তোলার জন্য রয়েছে সেই সামাজিক অনুকূল পরিবেশ। তাই নির্ভয়ে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব স্তরের, সব বিভাগের দায়িত্ব নিতে পেরেছে মেয়েরা। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ -এ নারীর শিক্ষা, মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে, একটা সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন রোকেয়া।
১৯৩১ সালে রোকেয়ার ‘অবরোধ-বাসিনী' প্রকাশিত হয়। অবরুদ্ধ যে নারী তিনিই অবরোধবাসিনী। অর্থাৎ বন্দিনী নারী। রোকেয়া জীবনের খণ্ডিত অভিজ্ঞতাকে এক সারিতে সাজিয়ে নারীদের অবরুদ্ধ জীবনের ছবি এঁকেছেন ‘অবরোধ-বাসিনী’-তে। এই গ্রন্থে মোট ৪৭টি পর্ব রয়েছে। প্রতিটি পর্বে সমকালীন নারীদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন রোকেয়া। বোরকায় বন্দিনী এক নারীর করুণ চিত্র ১৪ নম্বর পর্বে দেখিয়েছেন লেখক। যে চিত্র সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। এক বোরকা-বন্দিনী ট্রেনে ওঠার সময় ট্রেন ও স্টেশনের মাঝে পড়ে যান। তাঁর সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। তিনি একা তাঁকে টেনে তুলতে পারেননি। কুলিরা তাড়াতাড়ি সেই নারীকে তোলার জন্য ছুটে এলে, চাকরানি দোহাই দিয়ে বলেন, ‘খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।।’ চাকরানি অনেক চেষ্টা করেও বিবি সাহেবাকে তুলতে পারেননি। ট্রেনের চাকায় তিনি পিষ্ট হলেন। রোকেয়ার প্রশ্ন, ‘কোথায় তাঁহার “বোরকা” - আর কোথায় তিনি!’ প্রত্যেকটি পর্বে এইরকম নানা ঘটনা উপস্থাপন করেছেন লেখক। এই গ্রন্থটি মূলত পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে লেখকের লিখিত প্রতিবাদ। রোকেয়ার প্রতিবাদ আজও সমান ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বিজ্ঞান বিশ্বে, ২০২২ সালে ইরানের কুর্দ নারী মাহসা আমিনিকে প্রাণ দিতে হয়েছে হিজাবের বাইরে চুল বেরিয়েছিল সেই অপরাধে। কঠোর পর্দা পালনের নিয়ম মাহসা ভঙ্গ করেছিলেন। তাই ইরানের নীতি পুলিশের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ইরানের নারী-পুরুষ পথে নেমেছিলেন মাহসাকে সমর্থন করে। ২০২৫ সালে আফগানিস্তানে ভয়ংকর ভূমিকম্প হল। উদ্ধারকারী দল সবই পুরুষ। ‘নারীদের স্পর্শ করা যাবে না’, তালিবান সরকারের এই ফতোয়ার কারণে মেয়েদের এবং দশ বছরের উপর কন্যা শিশুদের উদ্ধার করতে অপারগ ছিলেন উদ্ধারকারী দল। নিকট আত্মীয় এসে উদ্ধার করতে পারলে তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন। ধর্মীয় রাজনীতি আর বাজার অর্থনীতির কারণে হিজাব, নিকাব, বোরকা নিয়ে এদেশের চিত্রও পাল্টাচ্ছে। স্কুলে, কলেজে হিজাব, বোরকা পরা মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা ঘরে আজ আর ততটা বন্দি নয়, কিন্তু পোশাক বন্দি হয়ে তবেই বেরোতে পারছে। এই অবরোধবন্দিনীরা বুঝতে পারছেন না, নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ। বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির এক ভাষণে রোকেয়া বলেছিলেন, ‘পর্দ্দা সম্বন্ধে আমি নিজের কোন মত প্রকাশ করিতে ইচ্ছুক নহি— কেবল এইটুকু বলি যে, শেখ সাহেব পর্দ্দাকে “সর্ব্বাপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত” বলিয়াছেন, আমি তাহা মনে করি না। “যন্ত্রণাদায়ক” হইলে অবলাগণ “বাবারে! মা’রে! মলুম রে! গেলুম রে!” বলিয়া আর্ত্তনাদে গগন বিদীর্ণ করিতেন।! অবরোধ-প্রথাকে কার্ব্বনিক এসিড গ্যাসের সহিত তুলনা করা যায়। যেহেতু তাহাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোকে কার্ব্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিবার অবসর পায় না!’ (অভিভাষণ প্রবন্ধ, রোকেয়া রচনা সংগ্রহ, বিশ্বকোষ পরিষদ, পৃ.৪১২)
দক্ষিণ এশিয়ার নারী জাগরণের ইতিহাসে পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুনির্দিষ্ট অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন রোকেয়া, কিন্তু রোকেয়ার প্রত্যাশা কি আজও পূরণ হয়েছে? সম্ভব হয়নি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা। সংগ্রামী রোকেয়ার আদর্শকে পাথেয় করে পথ চলার প্রতিশ্রুতি নিতে হবে আমাদের। নারীর ওপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিধিবিধান চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জারি থাক আমাদের লড়াই। স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে, দেশের সুনাগরিক হিসেবে রোকেয়ার দর্শনে স্নাত হয়ে আমরা যেন আগামীকে পাল্টাতে পারি এই ব্রত হোক রোকেয়া অনুগামীদের।
সৌজন্য 'মুক্তি' (রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির মুখপত্র)
0 Comments
Post Comment